শত শত বছর ধরে আরাকানে বসবাস করা রোহিঙ্গারা আজ নির্যাতিত জাতিতে পরিণত হয়েছে। এই জাতির জন্মভূমি আছে, কিন্তু নেই থাকার অধিকার। তাদের ঘর আছে, কিন্তু নেই নিরাপত্তার চাদর। তাদের জীবন আছে, কিন্তু নেই বেঁচে থাকার অধিকার। যারা শিশু আছে, কিন্তু নেই তাদের আনন্দময় শৈশব। বর্তমানে তারা সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির দ্বারা হত্যা, নির্যাতন, বাস্তুচ্যুতির শিকার হচ্ছেন। সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গা জাতির রক্ত যেন তৃষ্ণা নিবারণের পানির ন্যায়। তাদের কাছে রোহিঙ্গা মানেই অভ্যন্তরীণ শত্রু এবং খেল-তামাশার বস্তু।
২০১২ সাল থেকেই রোহিঙ্গা নিধনে সক্রিয় ছিল সন্ত্রাসী আরাকান আর্মিঃ
মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর সাথে সন্ত্রাসী আরাকান আর্মির সম্পর্ক আজ যেমন, আগে কিন্তু এমন ছিল না। তাদের ছিল গলায় গলায় বন্ধুত্বের সম্পর্ক। আর এই বন্ধুত্ব আরো বেশি কার্যকর ছিল রোহিঙ্গা নিধনে। ২০১২ সালে উগ্র রাখাইন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী নিপীড়িত রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর যে জাতিগত সহিংসতা শুরু করেছিল, তার মূলে ছিল এই আরাকান আর্মি।
আরাকান আর্মি শুরু করে এক জঘন্য মুসলিম বিদ্বেষী প্রোপ্যাগান্ডা। এসময় তারা প্রচার করতে থাকে যে, রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসী এবং তারা মিয়ানমারের জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি। তারই অংশ হিসেবে ২০১২ সালের মে মাসে তারা “৩জন রোহিঙ্গা যুবক ১জন রাখাইন বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছে” বলে ভুয়া তথ্য প্রচার করতে শুরু করে।
এর জের ধরে পুও রাখাইন অঞ্চলে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র রাখাইন মগরা ২০১২ সালের ৩ জুন তৌংগুপ (Toungup) এলাকায় ১০ জন মুসলিমকে বাস থেকে টেনে নামিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে।
এরপর রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধদের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে বিশেষ করে সিত্ত্ওয়ে (Sittwe) ও আশেপাশের গ্রামগুলোতে। রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেই সহিংসতায় অসংখ্য রোহিঙ্গাদের হত্যা করা হয় এবং ৯০,০০০ এরও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়। যদিও মিয়ানমার সরকার মাত্র ৮০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে বলে প্রচার করে।
জাতিসংঘ এই ঘটনাকে “Ethnic Cleansing” (জাতিগত নিধন) হিসেবে বর্ণনা করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (HRW) তদন্ত করে জানায়, ২০১২ সালের দাঙ্গা ছিল পরিকল্পিত ও রাষ্ট্র-সমর্থিত সহিংসতা।
এই ঘটনার পর প্রায় ১,৪০,০০০ রোহিঙ্গাকে জোর করে Internally Displaced Persons (IDP) ক্যাম্পে আটকে রাখে মিয়ানমার সরকার। এই ক্যাম্পগুলো কার্যত “খোলা কারাগার” হয়ে ওঠে। সেখানে বন্দী অবস্থায় জীবনযাপন করতে থাকে অসহায় রোহিঙ্গারা। শিক্ষা, চিকিৎসা, চলাফেরা সহ সব মৌলিক অধিকার রোহিঙ্গাদের জন্য সীমিত করে দেওয়া হয় বিনা কারণেই।
এসময় পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে উঠে যে, হাজার হাজার রোহিঙ্গা নৌকায় করে বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়ার দিকে পালাতে থাকে। এ সময় সমুদ্রপথে শত শত মানুষ মারা যায়। আন্তর্জাতিক মিডিয়া একে “Boat People Crisis” বলে অভিহিত করে।