২৫ শে আগস্ট ২০১৭। আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর সেদিন নেমে আসে ইতিহাসের বর্বোরচিত হত্যাযজ্ঞ। বিশ্ববাসী সেদিন প্রত্যক্ষ করেছে কিভাবে মায়ানমার জান্তা বাহিনী ও সন্ত্রাসী আরাকান আর্মি মিলে রোহিঙ্গাদের উপর নিষ্ঠুরতম গণহত্যা চালিয়েছে। আমরা দেখেছিলাম তাদের উপর চলা বর্বরতা—পুড়ে যাওয়া গ্রাম, নদীর পাড়ে পড়ে থাকা সারি সারি গলিত লাশ, ছোট ছোট নিষ্পাপ শিশুদের কান্না। কিছু সময়ের জন্য মুসলিম বিশ্ব সাড়া দিয়েছিল, প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে এসেছিলো।
আজ সেই ভয়াবহ গণহত্যার আট বছর হতে চললো!
তবে এই গণহত্যার ইতিহাস নতুন কিছু নয়। মজলুম রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উপর হওয়া গণহত্যার ইতিহাস পৃথিবীর মানুষ যা জানে তা খুবই সংক্ষেপিত। রোহিঙ্গা জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে, তাদের উপর চলা গণহত্যার ইতিহাস আজ আমরা আপনাদের সামনে তুলে ধরছি…
রোহিঙ্গা মুসলিমরা প্রথম গণহত্যার শিকার হোন ১৬৬০ সালে। বৌদ্ধ মগ রাজা শ্রীচন্দ্র সুধর্মা মুসলিম নাম ও উপাধি নিষিদ্ধ করেন। সে থেকেই আরাকানের মুসলিম শাসনের ঐতিহ্যমন্ডিত যুগের সমাপ্তি ঘটে। সুধর্মা কর্তৃক মোঘল রাজা শাহসূজা স্বপরিবারে খুন হবার পর থেকেই মুলত নির্যাতন ও গণহত্যা শুরু হয়। সেসময় মগরা আরাকানের মুসলিমদের হত্যার পাশাপাশি চট্রগ্রাম বন্দরে দাস-দাসী হিসেবে বিক্রি করতো।
১৭৭৫ সালে মুসলিমবিদ্বেষী রাজা বোধাপায়ার ইন্ধনে মগ সন্ত্রাসীরা আরাকানের উপর সরাসরি আক্রমণ করে। অগণিত রোহিঙ্গা মুসলিম সেসময় শহীদ হোন। জীবন বাঁচাতে ৩৫০০০ এরও অধিক রোহিঙ্গা মুসলিম চট্রগ্রামে চলে আসে। ১৭৮৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বোধাপায়া আবারো আরাকানে ৩০০০০ বার্মিজ সৈন্য নিয়ে আক্রমণ করে। তার এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল আরাকান অঞ্চলকে মুসলিমশূন্য করে ফেলা।
তার ঠিক ১৭ বছর পর ১৮০২ সালে আরেকটি গণহত্যা চালানো হয়, ফলে প্রাণ বাঁচাতে কক্সবাজারের রামুতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নেয়। সেসময় বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ফলে অসংখ্য রোহিঙ্গা মৃত্যুবরণ করে।
১৮২৬ সালে ব্রিটিশরা বার্মা দখলে নেয়ার পর আরাকান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পরে। এরপর বার্মাকে ইংরেজরা স্বায়ত্তশাসন দেয়, ফলে বহু রোহিঙ্গা মুসলিম আরাকানে ফিরে আসে। ব্রিটিশদের শাসনামলে রোহিঙ্গারা নিজেদেরকে শক্তিশালী করে। কিন্তু মগ রাখাইনরা তা সহ্য করতে পারে নি। তাই ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মার দখল জাপানের হাতে চলে গেলে তখন আবার গণহত্যা শুরু হয়।
১৯৪২ সালের ২৩ শে মার্চ জাপান আরাকানের আকিয়াব শহরে বোমা বর্ষণ করে। জাপানি যুদ্ধ বিমানগুলি যথাক্রমে ২৪ ও ২৭ শে মার্চ আকিয়াবে পুনরায় বোমা বর্ষণ করে। তাই ব্রিটিশ প্রশাসন ১৯৪২ সালের মার্চের শেষের দিকে আকিয়াব থেকে প্রত্যাহার করে নেয়। ঐ এলাকা থেকে ব্রিটিশ সেনা প্রত্যাহারের পর আরাকানের প্রশাসনিক পদগুলোতে শুন্যতা দেখা দেয়। সেসময় সন্ত্রাসী বো রাং অং এর নেতৃত্বে বার্মা ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (বিআইএ) এর সাথে যোগসাজশ করে মগসন্ত্রাসীরা প্রায় ১,০০,০০০ নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর গণহত্যা চালায়। ৩০০ মুসলিম গ্রামকে তারা পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করে দেয়।
বার্মা স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৬৪ সালে রোহিঙ্গাদের সকল অর্গানাইজেশন নিষিদ্ধ করে দেয় বার্মা সরকার। তার পরের বছর ই নিউজ চ্যানেলগুলোতে রোহিঙ্গা ভাষায় নিউজ করা বন্ধ করে দেয়। ১৯৭০ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিলের পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে তাদের সবধরনের নাগরিক সুবিধা বাতিল করে দেয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পরিচয়হীন করে দেয় খুনি নে উইনের সরকার!
এরপর ১৯৭৮ সালে কুখ্যাত জেনারেল নে-উইন রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ‘নাগা মিন (ড্রাগন কিং) অপারেশন’ পরিচালনা করে। এই অপারেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতিগত আন্দোলন দমন করা। এই সময় আরাকান ন্যাশনাল লিবারেশন পার্টির সঙ্গে রোহিঙ্গা মুসলমানদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তুলে নির্বিচারে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে শহীদ করা হয়। এই অপারেশনের ফলে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
১৯৯১ থেকে ৯২ সাল পর্যন্ত সন্ত্রাসী বার্মা সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে প্রায় ১৯ টি সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। নতুন করে শুরু হওয়া এই গণহত্যায় হাজারো রোহিঙ্গা মুসলিম শহীদ হন। চারলাখেরও অধিক রোহিঙ্গা বাধ্য হয়ে আবারো বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।